বোযকির আরসালানি জালালুদ্দীন সিজন ০১ সকল ভলিউমঃ
বোযকির আরসালানি জালালুদ্দিন সিরিজের ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটঃ-
ইতিহাস বিজয়ী আর বিজয়কেই ফলাও করে; পরাজয় আর পরাজিতকে ঢেকে
রাখে বিস্মৃতির আড়ালে; কিন্তু কোনো কোনো পরাজয় ও পরাজিত পক্ষ এতই
মহিয়ান হয়, তা গৌরবের দিক দিয়ে অনেক বিজয়কে ছাড়িয়ে যায়—দূর বহু
দূর। ইতিহাসের তেমনই পরাজিত এক মহানায়ক সুলতান জালালুদ্দিন
খাওয়ারিজম শাহ।জালালুদ্দিন ছিলেন খাওয়ারিজম সাম্রাজ্যের শেষ সুলতান।
তিনিই মোঙ্গল তথা চেঙ্গিস বাহিনীর প্রথম প্রতিরোধকারী। ইতিহাসে মোঙ্গলদের
সর্বপ্রথম পরাজিত করেছিলেন।তবে খাওয়ারিজম সাম্রাজের ইতিহাস
সংক্ষিপ্তভাবে তুলে ধরা হয়েছে মেন্দিরম্যান জালালুদ্দিন সিরিজটিতে। মোঙ্গলদের
আক্রমণে যখন গোটা মুসলিম বিশ্ব লন্ডভন্ড, ঠিক সে মুহূর্তে ধুমকেতুর ন্যায়
আবির্ভূত হয়েছিলেন সুলতান জালালুদ্দিন মুসলিমবিশ্বের ত্রাতা হিসেবে। চেঙ্গিস
খানের মোকাবিলায় তাঁর প্রতিরোধযুদ্ধ অসফল হলেও ব্যর্থ ছিল না মোটেও।
অন্তত সাত-আটটি বছর তিনি আটকে রেখেছিলেন তাদের বিজয়ের স্রোত।
দৌড়ের উপর রাখতে সক্ষম হয়েছিলেন সেই বিশ্বত্রাস শক্তিকে। ১২২১ সালের
কোনো এক বসন্তে, পারওয়ানের ময়দানে শুরু হয়ে গেল তুমুল যুদ্ধ। অস্ত্রের
ঝঙ্কারে পুরো ময়দান মুখরিত হয়ে উঠল। প্রথম দিন যুদ্ধে মঙ্গোলরা সুবিধা
করতে পারল না। রাতে তারা একটি আশ্চর্য ফন্দি আঁটল। নিহত সেনাদের লাশ
ময়দানের একটু দূরে নিয়ে গেল, তারপর লাঠি পুঁতে লাঠির সঙ্গে এই লাশগুলো
বেঁধে দাঁড় করিয়ে রাখল। এমন হাজার হাজার লাশকে দাঁড় করিয়ে দেওয়ার
ফলে দূর থেকে মনে হচ্ছিল, এখানে অনেক সেনা দাঁড়িয়ে আছে। সুলতান
জালালুদ্দিন ভেবে বসলেন, হয়তো বড় কোনো বাহিনী এসে মঙ্গোলদের সাথে
যোগ দিয়েছে। কিন্তু তিনি ভীতসন্ত্রস্ত হলেন না। পরদিন যুদ্ধের জন্য অপেক্ষা
করতে লাগলেন। সুলতানের অনন্য যুদ্ধকৌশল, আত্মবিশ্বাস এবং দৃঢ়তার কাছে
সেদিন পরাজিত হলো মঙ্গোলরা। এ যুদ্ধে প্রচুর মঙ্গোল সেনা মুসলমানদের
হাতে নিহত হয়। নিহত হন মঙ্গোল বাহিনীর সেনাপতি ও চেঙ্গিস খানের পুত্র
তোলি খানও। চেঙ্গিস খান অনুধাবন করলেন, জালালুদ্দিনকে থামানো না গেলে
তার পক্ষে আর সামনের দিকে এগোনো সম্ভব না। তাই সকল দিক থেকে দৃষ্টি
সরিয়ে মনোযোগ দিলেন জালালুদ্দিনের দিকে। এতে করে ইউরোপ এবং
আব্বাসীয় খিলাফত ততদিন পর্যন্ত নিরাপদ ছিল। চেঙ্গিস খান তার বিচ্ছিন্ন
সৈন্যদেরকে একত্র করতে লাগলেন চূড়ান্ত যুদ্ধের জন্য।চেঙ্গিস খান যখন চূড়ান্ত
যুদ্ধের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছেন, তখন গনিমতের মাল ভাগাভাগি করা নিয়ে
সুলতানের বাহিনী দু’ভাগে বিভক্ত হয়ে গেল। সুলতানের প্রধান সেনাপতি
সাইফুদ্দিন আগরাক প্রায় অর্ধেক সৈন্য নিয়ে দলত্যাগ করলেন। সুলতানের
অনুরোধে সাইফুদ্দিন দলে যোগ দিলেও পরের দিন গভীর রাতে তিনি তার
বাহিনী নিয়ে মুসলিম শিবির থেকে পালিয়ে যান। সুলতান চেয়েছিলেন, সিন্ধু নদ
অতিক্রম করে ভারতবর্ষে প্রবেশ করবেন। সেখান থেকে দিল্লির শাসক
শামসুদ্দিন ইলতুতমিশের সাহায্যে সেনাবাহিনীর গঠন করে পুনরায়
আফগানিস্তানে ফিরে এসে মঙ্গোলদের সঙ্গে লড়বেন। এদিকে চেঙ্গিস খান
বুঝতে পারলেন, সুলতান জালালুদ্দিন যদি কোনোভাবে সিন্ধু অতিক্রম করেন,
তাহলে আর তাকে আটকানো সম্ভব হবে না। তাই তিনি চাচ্ছিলেন, যেকোনো
উপায়ে সিন্ধু নদ পার হওয়ার আগেই জালালুদ্দিনকে ঘায়েল করতে হবে। শুরু
হয়ে গেল তুমুল যুদ্ধ। কয়েক লক্ষ দুর্ধর্ষ মঙ্গোল যোদ্ধার মোকাবেলা করা
সুলতানের পক্ষে সম্ভব ছিল না। ক্ষুদ্র মুসলিম বাহিনীর অবস্থানের ফলে বিস্তৃত
যুদ্ধক্ষেত্র সংকুচিত হয়ে এলো। অধিকাংশ মুসলিম সৈন্য নিহত হলো।
সুলতানের সাথে মাত্র হাতেগোনা কয়েকজন যোদ্ধা লড়তে থাকে মঙ্গোল বাহিনীর
বিপক্ষে। চেঙ্গিস খান তার সমস্ত শক্তি প্রয়োগ করেন সুলতানকে বধ করতে।
কিন্তু এই বিশাল বাহিনী নিয়েও হাতেগোনা সৈন্যের সঙ্গে সহজে পেরে
উঠছিলেন না তিনি। সুলতান জালালুদ্দিন যখন দেখলেন, কোনোভাবেই আর
মোকাবেলা করা সম্ভব নয়, তখন তিনি মঙ্গোলদের সাথে যুদ্ধ করতে করতে
উঠে গেলেন এক টিলায়। টিলার ডানপাশে বইছে উত্তাল সিন্ধু নদ। প্রায় ১৮০
ফুট উচ্চতা থেকে তিনি আচমকা ঘোড়াসহ ঝাঁপ দিলেন উত্তাল সিন্ধুর বুকে।
মঙ্গোলরা বিস্ময় চোখে তাকিয়ে ছিল সুলতানের দিকে। তারা ভাবতেও পারেনি
সুলতান হুট করে এমন কাজ করে বসবেন। সাঁতরে তিনি পার হয়ে এলেন
নদীর এপারে। ওপারে অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে রইল চেঙ্গিস খান ও তার কয়েক
লক্ষ সৈন্য।২৪ নভেম্বর, ১২২১ সাল। সিন্ধু নদীর পাড়ে নিলাব নামক স্থানে
সুলতান জালালুদ্দিন পড়লেন অকূল পাথারে। মঙ্গোল বাহিনী অতি নিকটে চলে
এসেছে, পেছনে খরস্রোতা সিন্ধু নদ প্রবহমান। সৈন্যদের পারাপারের জন্য
কোনো বাহন নেই। এখানে দাঁড়িয়ে সুলতান জীবনের সবচেয়ে কঠিনতম সিদ্ধান্ত
নিলেন। একদিকে তিনি জীবন বাজি রেখে চূড়ান্ত যুদ্ধের প্রস্তুতি নিলেন,
অন্যদিকে পরিবারের নারীদের নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বিগ্ন হয়ে উঠলেন। পরিবারের
নারীদের চেঙ্গিস খানের ভয়াবহতা থেকে রক্ষা পেতে খরস্রোতা সিন্ধুর বুকে
ভাসিয়ে দেন তিনি।এদিকে পুরো মঙ্গোল বাহিনী নিয়ে বিধ্বংসী রূপে এগিয়ে
আসছেন চেঙ্গিস খান। অন্যদিকে মুসলিম শিবিরে বিভক্তি আর অভ্যন্তরীণ
কোন্দলে সময় পার হচ্ছে। সুলতান জালালুদ্দিন তার বাহিনী নিয়ে গজনি ত্যাগ
করলেন। অসুস্থ হয়ে পড়া সত্ত্বেও সুলতান তীব্র বেগে ছুটতে থাকলেন সিন্ধু
অভিমুখে। সুলতানের মাত্র কয়েক হাজার সৈন্যকে ধাওয়া করতে লাগল কয়েক
লক্ষ সৈন্যের বিশাল মঙ্গোল ঝড়। ইতিহাসের মাজলুম সেই মহান সুলতান
জালালুদ্দিনের জীবনের ক্ষুদ্র অংশ ফুটে উঠেছে বোযকির আরসালানি জালালুদ্দিন
সিরিজে।